শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০১৫

গঙ্গাপ্রাপ্তি

|| গঙ্গাপ্রাপ্তি ||


(অভিধান অনুযায়ী, গঙ্গাপ্রাপ্তি শব্দটি সাধারণ অর্থে মৃত্যু, ও বিশেষ অর্থে গঙ্গাতীরে বা গঙ্গাজলে মৃত্যু, জ্ঞাপন করে)

বহুকাল পূর্বের কথা  | সেই কালে, বঙ্গের শহরে গ্রামে স্থানীয় নদীকে, সে যে নদীই হউক, চলিত কথায় গঙ্গা বলা হইত (যথা, “যাই গঙ্গায় নাই করে আসি”) | কিন্তু, অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ও সচ্ছল মানুষের মনঃপুত ছিল না যে তাহার মৃত্যু হইলে, ওই স্থানীয় গঙ্গাতীরেই তাহার অন্তিম সংস্কার করা হউক | অতি দরিদ্র মানুষ ব্যতিরেকে যে কেহই কিঞ্চিত অর্থ কিম্বা প্রতিপত্তি লাভ করিত, সে কামনা করিত যে তাহার অন্তিম সংস্কার যেন প্রকৃত গঙ্গাতীরে নির্বাহ করা হয় | এই উদ্দেশ্যে প্রকৃত গঙ্গা নিকটবর্তী না হইলে, স্থান বিশেষে অদূরবর্তী হুগলী নদীকেই গঙ্গা রূপে গণ্য করা হইত | হেন কারণে, হুগলী নদীর আশেপাশের বহু শহর কি গ্রাম হইতে মৃত ব্যক্তির মরদেহ হুগলী নদীতটে আনিয়া দাহকার্য, জলে অস্থি বিসর্জন ইত্যাদি ক্রিয়া সম্পন্ন করিবার প্রথা প্রচলিত ছিল |

এইরূপে, মায়াপুর গ্রামের হরিসাধন বাবুর মৃত্যু হইলে, গ্রামের পাঁচজন মনস্থ করিল, তাঁহার গঙ্গাপ্রাপ্তি করানো হইবে | তিনি দেবতুল্য মানুষ ছিলেন | গ্রামের দুর্গা পূজা বাবদ অর্থ ব্যয়ে ও অন্যান্য দীন দুঃখী সেবায় সকলের চক্ষে সম্মান শ্রদ্ধার পাত্র হইয়াছিলেন | সুতরাং তিনি ব্যতীত আর কে হইতে পারে মরণোত্তর গঙ্গাপ্রাপ্তির যোগ্য ? মায়াপুর হইতে সর্বাপেক্ষা নিকটস্থ হুগলী নদীর তটবর্তী শহর বৈরামগঞ্জ দশ – বারো ক্রোশ দূর | একটি মাত্র মোটরবাস, এই দূরত্ব যাইতে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা লয় – কেন না পথের বেশ কিছু অংশ পাকা নহে | উপরন্তু, গাড়িটি যাত্রী উঠাইয়া, নামাইয়া, থামিতে থামিতে যায় | কিন্তু, যথেষ্ট অর্থের প্রলোভন দেখাইয়াও ওই গাড়ির চালককে মৃতদেহ বহন করিতে সম্মত করানো গেল না | ওদিকে বর্ষা প্রায় সমাগত | আবহাওয়া মোটেই মৃতদেহ রক্ষণের উপযুক্ত নহে | তখন গ্রামের সর্বজ্ঞ পান্নালাল ঘোষ বাবু, পানু খুড়ো নামে জনপ্রিয়, প্রস্তাব করিলেন যে মরদেহ কাঁধে লইয়া বৈরামগঞ্জ যাওয়া হইবে | পানু খুড়ো আরও জ্ঞাপন করিলেন যে, যাহারা মৃতদেহ বহনে স্কন্ধ দান করিবে তাহারাও ওই পুণ্যবলে গঙ্গাপ্রাপ্তির ভাগ্য অর্জন করিবে |

গ্রামে হুড়াহুড়ি পড়িয়া গেল | কার্যত দশ জন সক্ষম তরুণ শববাহক পাওয়া গেল, যাহাদের উৎসাহের কোনও অন্ত নাই | কারণ, তাহারা ইতিপূর্বে বৈরামগঞ্জ কি, কোনও শহরই দেখে নাই | পানু খুড়ো তাহাতে বিশেষ বিস্মিত হইলেন না, কেন না তাঁহার এই প্রস্তাবের কারণ স্বয়ং তিনিও এই সুযোগে বৈরামগঞ্জ শহর দেখিয়া লইবেন | রক্ষা এই যে, এই সব পুত্রসম তরুণদের মধ্যে কেহই সেই গুপ্ত উদ্দেশ্য টের পাইবে না |

পরদিন অতি প্রত্যুষে, দলটি ‘বল হরি, হরি বোল’ রবে গ্রাম মুখরিত করিয়া বৈরামগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল | সাথে চলিল একটি গরুর গাড়ি, দাহ কার্যের জন্য কাষ্ঠ ও কিছু রন্ধনের সামগ্রী লইয়া | এই প্রান্তিক গ্রাম হইতে বহির্জগতে যাইবার একমাত্র পথটি বৈরামগঞ্জ শহরের দিকে গিয়াছে বটে | কিন্তু সেই পথে কিছু দূর যাইলেই একটি করিয়া গ্রাম আসে, ও পথটি বিভক্ত হইয়া এদিক ওদিক চলিয়া যায় – কিছু গ্রামটির ভিতর দিয়া, কিছু গ্রামটির বাহিরে বাহিরে | পাছে শববাহকরা ভুল পথে সময় ও শক্তির অপচয় করে, সর্বাগ্রে পানু খুড়ো দৃঢ় পদক্ষেপে পথ দেখাইতে দেখাইতে চলিলেন | প্রতিটি গ্রামে, মোটরবাস কোন পথে বৈরামগঞ্জ যায় এই প্রশ্ন করিয়া পাঁচ দশ গ্রামবাসীর মতামত লইয়া নিশ্চিত হইয়া শববাহকদিগকে পথ প্রদর্শন করেন | ইত্যবসরে শববাহকরা কাঁধ-বদল করিয়া, কিম্বা শব নামাইয়া রাখিয়া, যথাসম্ভব বিশ্রাম লয় | এইভাবে থামিয়া থামিয়া শবযাত্রা অগ্রসর হইল |

দ্বিপ্রহর হইলে একটি গাছের নিচে শব নামাইয়া সিদ্ধ-পক্ব ভাত রাঁধিয়া খাওয়া হইল | পানু খুড়ো সকলকে আশ্বাস দিলেন যে সন্ধ্যা নাগাদ বৈরামগঞ্জ পৌঁছানো যাইবে | কিন্তু সন্ধ্যা হইলে জানা গেল শহরে পৌঁছাইতে আরও ঘণ্টা দুই লাগিবে | সন্ধ্যা ঘোর হইয়া আসিলে দূরে শহরের আলো দেখা দিল | ক্লান্ত যুবকরা হৃত উৎসাহ ফিরিয়া পাইয়া পদচালনা দ্রুততর করিল | তথাপি, বৈরামগঞ্জ পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে সময় নবম প্রহর পার হইল | শ্মশানের খোঁজ পাইতে বিশেষ পরিশ্রম করিতে হইল না | শহরে প্রবেশ করিয়াই গঙ্গার পার্শ্বে যে বড় রাস্তা পাওয়া গেল তাহার শুরুতেই “জাগ্রত-কালী” শ্মশান, বাম হস্তে রাস্তা ও দক্ষিণ হস্তে গঙ্গার মধ্যবর্তী | প্রচুর প্রাচীন বৃক্ষের বাগানে সংলগ্ন জাগ্রত-কালীর মন্দির, ও তাহার পার্শ্বেই নদী তীরে শবদাহ করিবার স্থান | কিন্তু কালী মন্দিরটি ততক্ষণে বন্ধ হইয়া গিয়াছে | যে একটি মাত্র ডোমের দেখা পাওয়া গেল সেও স্বগৃহে ফিরিবার প্রস্তুতি করিতেছে | সে জানাইল যে শেষকৃত্য সম্পন্ন করিবার পুরোহিত মহাশয় নিদ্রা গিয়াছেন | আগামীকাল সকালের পূর্বে কোনও দহন কার্য সম্ভব নহে | ততক্ষণ শববাহকরা মন্দির প্রাঙ্গণে রাত্রি যাপন করিতে পারে | তবে লক্ষ্য রাখিতে হইবে যে কোনও জন্তু যেন মৃতদেহ আক্রমণ না করে | এই কয়েকটি কথা বলিয়া ডোম বিদায় লইল |

ইতিমধ্যে অমাবস্যার অন্ধকারে অজান্তে মেঘের সঞ্চার হইয়া গুমোট গরম ধরিয়াছিল | সহসা সেই নিশ্ছিদ্র নিকষ কালো শামিয়ানা বিদীর্ণ করিয়া মুহুর্মুহু হুঙ্কার সহযোগে বিদ্যুৎ ঝিলিকের অসিযুদ্ধ শুরু হইল, এবং আর্দ্র শীতল বাতাসের ঝটিকা আশু ঝড়-বৃষ্টির অগ্রিম আভাস দিল | পানু খুড়ো সকলকে তাড়া দিয়া মৃতদেহটি মন্দিরের চত্বরে রাখিয়া চতুর্দিকে প্রদীপ জ্বালিয়া রাখিবার ব্যবস্থা করিলেন | লন্ঠনের আলোয় অনুসন্ধান করিয়া নিকটেই একটি তেঁতুল গাছের পাদদেশে একটি পূর্বে ব্যবহৃত উনুন পাওয়া গেল | চটপট কাষ্ঠ জ্বালাইয়া রন্ধনের ব্যবস্থা করা হইল |

চারিদিক নিস্তব্ধ | সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত শববাহক যুবক সকল কেহ কথা কহিতেছে না | কেবল উনুন হইতে প্রজ্বলিত কাঁচা কাষ্ঠ ফাটিবার ফুটফাট শব্দ শোনা যাইতেছে | এমন সময় দূর হইতে বিলম্বিত লয়ে ক্যানেস্তারা কর্তনের কর্কশ শব্দের ন্যায় একটি গোঙানির আওয়াজ বাতাসে ভাসিয়া আসিল | দূর হইতে আগত সেই নির্ঘোষ ক্ষীণ হইলেও এত সুস্পষ্ট ও জান্তব যে মনে হইল যেন কোনও জন্তু করাতের মত দাঁত দিয়া অসম্ভব কঠিন কোনও জিনিস কাটিতে চেষ্টা করিতেছে | সচকিত হইয়া সবে একে অপরের দিকে চাহিল | কিন্তু, পর মুহূর্তেই নিস্তব্ধতা বিরাজ করিলে কান পাতিয়াও কেহ বিশেষ কিছু বুঝিতে পারিল না | কেবল সমর, শববাহকদিগের একজন, প্রশ্ন করিল, “পানু খুড়ো, ওটা কিসের আওয়াজ ছিল ?” পানু খুড়ো এইরূপ শব্দ পূর্বে কখনও শুনেন নাই | কিন্তু কোনরূপ অনভিজ্ঞতা স্বীকার করা তাঁহার আত্মসম্মানে বাধে | তিনি মনে মনে কিছু উপযুক্ত উত্তরের মুসাবিদা করিতেছেন কি, সহসা অতি নিকট হইতে সেই বিকট আর্তনাদ আবার শোনা গেল – মূহুর্মূহু, একের পর এক, কতিপয় উৎস হইতে | মনে হইল যেন কেহ বা কাহারা মস্ত বড় কোদাল দিয়া বিশাল জালার বাহিরে ও ভিতরে চাঁছিয়া শব্দ করিতেছে | সমর কহিল, “এ তো মনে হয় কোনও ভয়ঙ্কর জন্তু ...” তাহার মুখের কথা কাড়িয়া সুবল কহিল, “বাঘ নয় তো ?” কিন্তু হলধর, যাহার শ্রবণশক্তি কিঞ্চিত ক্ষীণ, সে দৃঢ় বিশ্বাসে কহিল, “বাঘ নয় | মনে হয় ওগুলো ফেউ, গঙ্গার ওপারে খাওয়া-খাওয়ি করছে |” দৃঢ় পণ সমর প্রশ্ন করিল, “ওপারে ফেউ বলে কি এপারে বাঘ চরতে পারে না ?” হলধর কহিল, “না, তা সম্ভব নয় |”

এই সব গ্রামবাসী জীবনে গবাদি পশু, কুকুর কি শৃগাল ব্যতীত অন্য কোনও জন্তু দেখে নাই | হলধরের বরাভয় সমাপ্ত হইবামাত্রই শ্মশানের ঠিক বাহিরে পাকা রাস্তার উপর ঠকঠক শব্দ করিয়া যেন কোনও চতুষ্পদ জন্তু দৌড়াইয়া পলাইল | তাহার পলায়নের শব্দ দূরে মিলাইয়া যাইবার পূর্বেই রাস্তার উপর আবার ঠকঠক শব্দ করিয়া কোনও জন্তু দ্রুতপদে নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল | অতঃপর শ্মশানের প্রবেশ দ্বারের দিক হইতে একই ভয়ঙ্কর কর্ণবিদারী নির্ঘোষ নিনাদ শোনা গেল, এবং একাধিক বার দ্রুততালে সেই নির্ঘোষের অনুক্রম ধ্বনি-প্রতিধ্বনির ন্যায় গুঞ্জিত হইতে থাকিল | ততক্ষণে সকলের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হিম ও রক্ত জল হইয়া গিয়াছে | কেহ অস্ফুট স্বরে কহিল, “খুড়ো, কী হবে এখন ? উপায় কী ?” তাহার কথা শেষ হইবার পূর্বেই পানু খুড়ো, “শিগগির ! সবাই চট করে এক একটা গাছের নিচে আগুন জ্বেলে, গাছে উঠে পড়,” এই কহিয়া তিনি স্বয়ং জ্বলন্ত উনুনের ভ্রুক্ষেপ না করিয়া এক লম্ফে তাহার ঠিক উপরে গাছের একটি ডাল ধরিয়া আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় তাহাতে উঠিয়া পড়িলেন | তাঁহার দেখাদেখি অন্যান্য সকলেও তৎক্ষণাৎ উনুন হইতে প্রজ্বলিত কাষ্ঠ লইয়া চতুর্দিকে দৌড়াইয়া নিকটে যে যাহা গাছ পাইল তাহার নিচে কোনও মতে এক দুইখানি কাষ্ঠে আগুন জ্বালাইয়া জোড়ায় জোড়ায় গাছে চড়িয়া যথা সম্ভব উপরে উঠিয়া বসিল | কেবল গোরুর গাড়ির চালক মহেশ গাড়ির সামগ্রী নামাইয়া রাখিয়া গোরুগুলিকে জল পান করাইতে লইয়া গিয়াছিল | সে হয়তো ফিরে নাই, বা ফিরিয়া আসিলেও সে কোনও সাড়াশব্দ করিল না |

কিছুক্ষণের মধ্যেই হাওয়ার দাপটে লন্ঠনটি নিভিয়া গেল | তুমুল বৃষ্টি নামিল | বৃষ্টির জলে সব আগুন একে একে নিভিয়া গেল | সেই বৃষ্টির জলের শব্দ এমন প্রচণ্ড যে আর কিছুই শোনা যায় না | তথাপি, পানু খুড়ো আন্দাজ করিলেন গাছের ডালে ডালে বিরাজমান যুবকরা কেহই টুঁ শব্দটিও করিতেছে না | কে জানে তাহারা জাগিয়া আছে কিনা ? যদি ওই অবস্থায় কেহ ঘুমাইয়া পড়ে (সকলেই যেরূপ ক্লান্ত) ও বৃষ্টিতে পিচ্ছল গাছের ডাল হইতে পড়িয়া যায়, তবে তাহার কী গতি হইবে ? গ্রামে ফিরিয়াই বা কী করিয়া লোকজনকে মুখ দেখাইবেন ? কী কহিবেন ? স্বচক্ষে না দেখিয়া শুধুমাত্র শ্রবণের ভিত্তিতে নরখাদক বাঘের বর্ণনা কী রূপে করিবেন ? – এই সব চিন্তায় তাঁহার ঘুম আসিল না |

ক্রমে ক্রমে বৃষ্টিপাতের বেগ হ্রাস পাইল | বৃষ্টি থামিলে, এদিক ওদিকের বৃক্ষ হইতে দু একটি চড় চাপড়ের শব্দ শুনিয়া পানু খুড়ো নিশ্চিন্ত হইলেন যে বৃক্ষারূঢ় যুবকরা মশার উপদ্রবে ঘুমায় নাই, জাগিয়া আছে | একবার তাঁহার মনে হইল এক এক করিয়া নাম ধরিয়া ডাকিয়া দেখেন কে আছে, কে নাই | ঠিক তখনই তাঁহার গাছের নিচেই পর পর ধপাস-ছপাস শব্দ করিয়া কিছু জিনিস যেন উপর হইতে নিচে বৃষ্টির জমা জলে পড়িল | সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বৃক্ষ হইতে বিভিন্ন ভয়ার্ত স্বরে শোনা গেল, “কে ? কে পড়ল ?” ... “পানু খুড়ো কোথায় ?” ... “এই, চুপ কর ! টুঁ শব্দও করবি না  ...”

এই ক্ষণিকের আকস্মিক কোলাহল শান্ত হইলে স্পষ্ট শোনা গেল নিচে কোনও ভারী জিনিস ছেঁচড়াইয়া টানিয়া লইয়া যাইবার শব্দ | একটু পরেই কিছু চর্বণ করিয়া ভক্ষণ করিবার শব্দ শোনা গেল – নরখাদকটি কখনও কড়মড়, তো কখনও মুচমুচ শব্দে কিছু চিবায়, আবার কখনও শুধু লালা-মিশ্রিত খাদ্য ভক্ষণের সপসপ শব্দ শোনা যায় | এইরূপ নানাবিধ শব্দে অনেকক্ষণ আহার করিতে করিতে নরখাদকটি হটাত হাঁচিতে শুরু করিল | বোধহয় সে হাঁচির বেগ সামলাইতে না পারিয়া ক্ষিপ্ত হইয়া হাঁচিতে হাঁচিতে সবেগে পলায়ন করিল | পানু খুড়ো ডোমের সাবধান বাণী স্মরণ করিয়া মনে মনে প্রমাদ গণিলেন যে আর বোধহয় সকাল বেলায় মৃতদেহটি অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যাইবে না, সৎকার না করিয়াই গ্রামে ফিরিতে হইবে | ‘কিন্তু,’ তিনি মনে মনে বিস্মিত হইলেন, ‘তাহলে বাঘটার নাম কী ঢুকে যাওয়াতে বাঘটা পালাল ?’

ভগবানদের কী বিচিত্র লীলা | সব আতঙ্ক ক্রমে ক্রমে নিদ্রায় বিলীন হইল | একে একে যে যাহার বৃক্ষশাখা জড়াইয়া ধরিয়া ঘুমে অচেতন হইল |

অতি প্রত্যুষে ডোম আসিয়া এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখিতে পাইল | নিচে মন্দির চত্বরে তিন দিনের বাসি মড়া গরমে ও বৃষ্টিতে ফুলিয়া ঢোল হইয়াছে | আশেপাশে কেহ নাই | একটি তেঁতুল গাছের নিচে নির্বাপিত উনুনের উপর ভাতের হাঁড়ি বসান | পাশে একটি লন্ঠন কাত হইয়া পড়িয়া আছে | অনতিদূরে একটি বস্তা হইতে লুণ্ঠিত যাবতীয় খাদ্য সামগ্রী – চাল, ডাল, বড়ি, চালভাজা, হলুদ, লঙ্কার গুঁড়া ইত্যাদি – ছড়াইয়া ছিটাইয়া পড়িয়া, ও তাহার চারিপাশে কাদায় কোনও চতুষ্পদ জন্তুর ক্ষুরের বিক্ষিপ্ত পদচিহ্ন | ডোম দৃষ্টি এদিক ওদিক করিয়া দেখিল উপরে গাছের ডালে ডালে জনা দশ বারো মানুষ নানাবিধ ভঙ্গিতে – কেহ বানর, কেহ বাদুড়, কেহ পক্ষীর ন্যায় – নিদ্রামগ্ন | ডোম দৌড়াইয়া গিয়া মন্দিরের বন্ধ দরজার উপর করাঘাত করিয়া ডাকিতে লাগিল, “ঠাকুর মশাই ! শিগগির উঠুন | কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড হয়েচে ... শিগগির উঠে আসুন, দেখুন | হে মা কালী ...”

এই চীৎকারে পানু খুড়ো জাগিয়া উঠিয়া দ্রুত বৃক্ষ হইতে নিচে অবতরণ করিলেন ও বেশি হাঁকডাক অপচয় না করিয়া, একটি গাছের ডালের খোঁচা দিয়া বাকি সকলকে জাগাইলেন | সকলে নিচে নামিয়া চক্ষু বারম্বার কচলাইয়া দেখিয়া অবাক হইল যে মৃতদেহ এখনও বর্তমান, যদিও এত ফুলিয়াছে যে চেনা মুশকিল !

সৎকার ক্রিয়া সমাপ্ত হইতে বেলা হইল | পুরোহিত মহাশয়কে কিঞ্চিত অধিক দক্ষিণা প্রদান করিয়া পানু খুড়ো ক্ষেদের সহিত কহিলেন, “চাল, ডাল, তেল, ঘি, হলুদ, নুন কিছুই দিতে পারছি না ... কাল রাত্তিরে বাঘ এসে সব নষ্ট করে গিয়েছে |” পুরোহিত মহাশয় আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “বাঘ ?” পানু খুড়ো কহিলেন, “হ্যাঁ, সে কী তর্জন গর্জন ! আমরা তো গাছে উঠে পড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি | তবে ভাগ্যিস বাঘটা মড়াটা খায়নি |” এই তথ্যের সহিত সম্মত হইয়া পুরোহিত মাথা নাড়িলেন | পানু খুড়ো শুধাইলেন, “আচ্ছা, বাঘটা মড়া না খেয়ে চাল, ডাল কেন খেল বলুন তো ? মড়াটা বাসি বলে ? নাকি, জলে ভিজে ফুলে ঢোল হয়েছিল, বলে ? কোথায় থাকে এমন বাঘ ?” পুরোহিত মহাশয় হুগলীর অপর তটের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া কহিলেন, “শুনেছি ওপারে ভৈরব মণ্ডলের জঙ্গলে নাকি এক আধটা বাঘ থাকে | বা, থাকত ... কিন্তু, বহুদিন কেউ তাদেরকে দেখে নি, তাদের ডাকও শোনে নি | আপনি ঠিক শুনেছিলেন, বাঘের ডাক ?”

ঠিক সেই মূহুর্তে শ্মশানের বাহিরের রাস্তা হইতে সেই ভয়ঙ্কর ডাক শোনা গেল | চমকিত যুবাগণ পানু খুড়োর সহিত একত্রিত হইয়া, পিঠে পিঠ লাগাইয়া ঘনিষ্ঠ হইয়া দাঁড়াইয়া আত্মরক্ষার বেষ্টনী সৃষ্টি করিল | অতঃপর সকলে ভয়ে ভয়ে রাস্তার দিকে চাহিয়া দেখিল একটি লোক একটি চতুষ্পদ জন্তু লইয়া যাইতেছে | রামছাগল অপেক্ষা সামান্য বড় জন্তুটির সহিত মানুষ দেখিয়াই সকলে কিঞ্চিত আশ্বস্ত বোধ করিল | যেন জন্তুটি চিনিতে পারিয়া সমর কহিল, “এতো দেখতে কিছুটা জগুবাবুর ইতিহাসের বইয়ের সেই চেতক ঘোড়াটার মত, তাই না ?” শশাঙ্ক, যে পড়াশোনায় অপেক্ষাকৃত কৃতী, কহিল, “ধুর, দেখছিস না এটার কানে কত চুল, চোখ দুটো ডাগর হলেও কত বোকা বোকা, আর দেখতে কত খিটখিটে ?” পৃষ্ঠে একগাদা কাপড়ের গাঁট চাপান জন্তুটির অবস্থা দেখিয়া বোঝা গেল যে বোঝার ভারে সে নড়িতে পারিতেছে না | লোকটি হাতের লাঠি দিয়া তাহার ঠ্যাঙে প্রহার করিলে সে পুনরায় ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করিল | তাহা শুনিয়া সকলে একত্রে শিহরিয়া উঠিল | কেবল পানু খুড়ো ম্রিয়মাণ কণ্ঠে কহিলেন, “ওই তো ! ওই শুনুন, সেই ভয়ঙ্কর ডাক !”

পুরোহিত মহাশয় কাষ্ঠ হাসি হাসিয়া কহিলেন, “মনে হয়, আপনারা বৈরামগঞ্জে এই প্রথম এলেন | তাই এখানকার বিখ্যাত গাধার-ডাক আগে কখনও শোনেন নি |”

---------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৬ জুন ২০১৫

1 টি মন্তব্য:

ranjit banerjee বলেছেন...

Milton,
You are awesome.Keep up the good work.
Ranjit