শুক্রবার, ১২ জুন, ২০১৫

জাম কুড়ানোর পালা



|| জাম কুড়ানোর পালা ||

ক্রীড়া সদনের পাশে যে রাস্তায় ভোর ভোর হাঁটতে যাই, সেটা ভারী সুন্দর | হালকা চড়াই উতরাই নিয়ে রাস্তাটা এঁকে বেঁকে গেছে মাইল খানেক | একপাশে সমান ঘাসের খেলার মাঠ, অন্যপাশে জমিটা কয়েক হাত উঁচু | সেখান থেকে কিছু কৃষ্ণচূড়া, কিছু জিলাপি, আর অনেক অচেনা গাছ রাস্তাটার উপর মাতৃস্নেহে ঝুঁকে আছে ছায়ার আঁচল বিছিয়ে | আর তার মাঝে এক দুটো জামের গাছ – একটু বেমানান | ঝড় ঝাপটা হলে পরদিন দেখি জাম গাছ তলায় অজস্র জাম পড়ে আছে | পাদচারীরা তার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, জাম, কৃষ্ণচূড়া ফুল সমান তাচ্ছিল্যে মাড়িয়ে |

কদিন ধরে এই জাম নিয়ে এক কান্ড দেখলাম | তার কথা বলি –

যারা নিয়মিত হাঁটতে আসে, তারা প্রায় সবাই একা | গরমের ছুটি হলে একটু একটু করে ‘গ্রীষ্ম শিবিরে’ নিয়ে আসা স্থানীয় বাচ্চাদের বাবা মা পাদচারীদের ভিড় বাড়াতে লাগল | তারা রোজ ওই ঘণ্টা কয়েক কোথায় যাবে ? তাই, এদিক ওদিক উদ্দ্যেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ায়, আর তাদের জুড়ি এই ভিড়ে যারা একা হাঁটে তাদের উপস্থিতি যেন বেশি প্রকট করে তোলে |

সেই প্রকটিতদের মধ্যে একজন মহিলা খুব ঢ্যাঙ্গা, রোগা, রং ময়লা | খেলার লাল গেঞ্জি আর নীল পায়জামা পরে খালি পায়ে দ্রুত গতিতে হাঁটে | যদিও শরীরের বক্রতা এখনও সুস্পষ্ট, বয়েস তিরিশের কোনদিকে তা বোঝা মুশকিল  | দ্বিতীয় মহিলা দেখে মনে হয় সদ্য স্কুল ছেড়ে কলেজে যাওয়া উনিশে পড়ুয়া মেয়ে | মেদ ভারে সম্পন্ন শরীরটা খাটো | চোখে চশমা, পরনে কিশোরী সুলভ হলুদ টপ আর বাদামী স্ল্যাক্স | ভালো করে লক্ষ্য করলে তার নাভির কাছে স্ফীতি দেখে মনে হয় সে সংসারে ঢুকে পড়েছে | এর কানে লাগানো থাকে গান শোনার তার | মাথা নিচু করে শ্লথ গতিতে হাঁটে | আবার মাঝে মাঝে পার্কিঙে গিয়ে গাড়িতে দরজা খুলে ড্রাইভারের জায়গায় বসে থাকে | তৃতীয় মহিলা চল্লিশের কাছাকাছি | অসম্ভব মোটা কিন্তু খুব সাবলীল | পরনে গায়ের সাথে চিপে লেগে থাকা বিসদৃশ গোলাপি গেঞ্জি আর আকাশী নীল প্যান্ট | তার দ্রুত হাঁটার মধ্যে একটা অদ্ভুত আলস্য | এই তিন জনেরই ব্যক্তিত্বে একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য একটা সুস্পষ্ট একাকীত্ব | চতুর্থ জন সাদা হাফপ্যান্ট আর সাদা গেঞ্জি পরা বছর পঁচিশের এক রোগা শিখ যুবক | পাগড়ি হীন মুখে অসম্ভব বুনো চুলদাড়ি | চেহারা, চুল সব মিলিয়ে একটা অসহিষ্ণু খিটখিটে ভাব |

একদিন দেখলাম হলুদ সাদার সাথে হাঁটছে | কথাও বলছে অনর্গল – কিন্তু পাশাপাশি হাঁটছে একটু দূরত্ব রেখে | ক’দিনেই সেই দূরত্ব কম হল | আসতে যেতে অতিক্রম করার সময় কথা না বুঝলেও, স্বর শুনে মনে হল পরিচিতির অন্তরঙ্গতা জমে উঠেছে | আবার কিছু দিন দেখি সাদা একা একা হেঁটে বেড়ায় – হলুদের সঙ্গ নেই | একদিন দেখি হলুদ লালের সাথে ভাব করেছে | লালের সাথে পাল্লা দিয়ে জোরে হাঁটছে, কান থেকে ইয়ার-ফোন খসে পড়েছে | উত্তেজিত দুজনের কথাবার্তা | এই সখিত্ব কিছুদিন চলল | তারপর হলুদ আবার একাকিনী | একদিন দেখি একটা জাম গাছ তলায় লাল আর গোলাপি জাম কুড়চ্ছে | হলুদ পাশ কাটিয়ে চলে গেল | তার পিছনে একটু পরে সাদা গেল | ধরতে পারলাম না কে কবে কার সঙ্গ নেবে সেটা কী ভাবে ঠিক হয় |

আশ্চর্য হলাম, একদিন দেখি একটা ছোট গাছের নিচে চারজনকে একসাথে | সাদা গাছের একটা নিচু ডাল ধরে ঝাঁকাচ্ছে, আর হলুদ, গোলাপি আর লাল নিচে হুমড়িয়ে পড়ে নানান শিশুসুলভ হামাগুড়ির ভঙ্গিতে কিছু কুড়চ্ছে | এক দফা ঘুরে এসে দেখি একই দৃশ্য, তবে আরও উদ্দীপ্ত | তিনটি মেয়েলি গলায় প্রচুর উত্তেজনা একসাথে সাদাকে প্ররোচিত করছে | তার খিটখিটে ভাব মনে হল কিঞ্চিত মোলায়েম হয়েছে | গাছটাকে ভালো নজর করে সন্দেহ হল জাম গাছ | কিন্তু কোন জাম দেখতে পেলাম না | ক’দিন পরে দেখি তিন জম্বু-রঙ্গিণী গাছের নিচে জমায়েত | সাদা রাস্তার উল্টোদিকে শুকনো গাছের ডাল খুঁজে বেড়াচ্ছে | একটু পরে দেখলাম সে সেই ডাল গাছের উপরের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে | আর তার সাথে সাথে মহিলা কণ্ঠের উত্তেজিত কুহরণ – বুঝলাম ফলন অপ্রত্যাশিত ভালো | একটু পরে দেখা গেল চারজন গোল হয়ে ঘাসে বসেছে | দূরত্বের সম্ভ্রম চুলোয় গেছে | প্রায় হাঁটুতে হাঁটু ঠেকিয়ে মাঝখানে একটা রুমালে রেখে তুলে তুলে জাম খাচ্ছে সবাই | সেই সাথে গল্প, হাসাহাসি | মনে হল, ‘আচ্ছা, এদের কি বাড়িঘর নেই ? অবশ্য আমি বা তা জেনে কী লাভ করব ?’

এখন গরমের ছুটি শেষ | পাদচারীর ভিড়ও কম | বর্ষা নামলে জামগাছে আরও বড়, আরও রসালো জাম হবে | শুধু তিন জম্বুরঙ্গিণী আর আসবে না | সর্দারজীও জল কাদা থেকে সাদা কাপড় বাঁচিয়ে হেঁটে ফিরে যাবে | যারা উল্কার মত কাছে এসেছিল তাদের স্মৃতি সরিয়ে রেখে ? ওরা কি কেউ কাউকে জিজ্ঞাসা করেছিল কে কোন সৌরমণ্ডল থেকে এসেছিল ? নাকি, এসেছিল, শুধু জাম খেতে ভাব করেছিল – এই জ্ঞানই যথেষ্ট ?

এ কথা থেকে সে কথায় মন চলে যায় |

আমি তখন খুব একটা ছোট নই, বীরহাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়া শুরু করেছি | গরমের ছুটিতে দেশ গ্রামে গেলে পাশের বর্ধিষ্ণু গ্রাম রাঙাপুরে যাই বাবার স্কুলের বন্ধু দীনুকাকার কাছে | দীনুকাকা পোস্টমাস্টার | এককালের জমিদারের পোড়ো বাড়ির বৈঠকখানায় রাঙাপুর পোস্টঅফিস | বাড়িটার বাকি ঘর কবেই পড়ে গিয়েছে, শুধু তার বিশাল দু’কামরার রান্নাঘর তখনও অক্ষত | তাতেই দীনুকাকা আর কাকিমা থাকেন | মাতৃসমা কাকিমার টানে যাওয়া | কাকিমা মাতৃস্নেহে আমাকে স্থানীয় ছেলে মেয়ের সাথে বড় একটা মিশতে দেন না, শহুরে ছেলে কোথায় মফস্বলের কী না কী আজেবাজে প্রভাবে পড়ে যাবে | আমিও একা থাকতে ভালোবাসি | একা একা ঘুরে বেড়াই ওই জমিদার বাড়ির বাগানে | বেশিরভাগটাই আগাছায় দুর্গম | কিন্তু এক কোনে দেয়াল ঘেঁসে একটা মস্ত জামগাছ | তার প্রথম ডালটা লাফিয়ে ধরে উপরে উঠে বসে থাকি | ডালটা যেখানে গাছটার গুঁড়ি থেকে বেরিয়েছে সেখানে একটা গর্ত মতন – শুকনো পাতা আর জামের বিচিতে ভরা | তাতে দেখি কাঠবিড়ালি আসা যাওয়া করে | জানি না ওরা জাম খায় কি না | আমি উঠে বসলে ওরা পালিয়ে যায় | কোন কোন দিন দেখি ওর ভিতরে পুরুষ্টু জাম পড়ে আছে, তুলে জামায় মুছে খাই |

একদিন এমনি উঠে বসে ডালটায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে উপরে তাকিয়ে তন্ময় হয়ে আছি, হটাত শুনলাম মেয়েলি গলায়, “এই, ওই খোকলায় জাম আছে ? দে না দুটো আমাকে |” নিচে তাকিয়ে দেখি একটা শাড়ি পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে | আমি ধড়মড় করে উঠে বসে বললাম, “কোথায় বললে ?” মেয়েটা হেসে বলল, “ওই তুই যেখানে পা লাগিয়ে বসে আছিস, গত্ত আছে না একটা ?” আমি মাথা নাড়লাম, “ছিল, আমি সব খেয়ে ফেলেছি |” মেয়েটা বলল, “কাল আসবি না ? আমার জন্য রেখে দিস |” আমি জিজ্ঞাসা করব ও কে, তার আগেই ও ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল | ঘরে ফিরে বলি বলি করেও কাকিমাকে বলতে পারলাম না | পরদিন আমি গাছে উঠবার আগে নিচ থেকে একটা শুকনো ডাল ছুঁড়ে কিছু জাম পেড়ে সেগুলো পকেটে পুরে উঠে বসলাম | পকেট থেকে জামগুলো বের করে খোকলাতে রেখে উপরে তাকিয়ে বসে রইলাম | তন্দ্রা এসে গিয়েছিল কি শুনলাম, “কই, কিছু রেখেছিস ?” নিচে তাকিয়ে দেখি দৃষ্টিতে প্রত্যাশা নিয়ে দাঁত বের করে বিব্রত মুখে হাসছে মেয়েটা | আমি বললাম, “ফেলি ?” ও বলল, “দাঁড়া |” তারপর কাঁধ থেকে আঁচল নামিয়ে দু’হাতে মেলে বলল, “এর উপরে ফেলে দে |” আমি ফেলব না দেখব, ওর শাড়ির সাথে ব্লাউজের বদলে পরা ফ্রকে ফুটে ওঠা  যৌবনের চাপা উদ্ভাস | ও আবার বলল, “বললাম তো, ফেল জামগুলো | দেখছিস কী?” আমার কান লাল হয়ে উঠল | দু’হাতে জামগুলো ছুঁড়ে ফেললাম ওর আঁচলে | “এতো গুলো ... যাই বাড়ি নিয়ে যাই” বলে মেয়েটা ছুটে পালাল ওই ঝোপঝাড়ের পথ দিয়ে |

কিছুদিন পরে ধরা পড়ে গেলাম – কেন না জামার দুই বুক পকেটে জামের দাগ লেগে গিয়েছিল, কাকিমা জামা কাচতে গিয়ে ধরে ফেলল | আমি তাও বললাম না মেয়েটার কথা | পরের দিন মেয়েটা এসে দেখল আমি নিচে দাঁড়িয়ে | খুব হেসে বলল, “জাম কই ? ধরা পড়ে গিয়েছিস বুঝি ?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কিসের ধরা ?” ও সোজা উত্তর না দিয়ে বলল, “আমি দেখেছি, রোজ তুই আগে ভাগে জাম পেড়ে পকেটে পুরে গাছে উঠে বসিস |” আমি খানিকটা নিঃস্পৃহ গলায় বললাম, “আজ জাম চাই না ?” মেয়েটা হটাত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “না, থাক | যাই, কেউ দেখলে কী বলবে ?” তারপর মুখ ঘুরিয়ে মেয়েটা ধীর পায়ে চলে গেল |

আমার কী মনে হল, বাড়ি ফিরে কাকিমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ওই দিকে জামগাছের কাছে একটা মেয়ে আসে, আমায় দেখলে জাম চায়, ও কে ?” কাকিমা আশ্চর্য হয়ে বলল, “ফ্রকের উপর শাড়ি পরে ?”
আমি – “ফ্রক ? অত দেখি নি |”
কাকিমা – “কে জানে, হারান বাগদির মেয়ে হাসি হবে হয়তো ...”
আমি – “হারান কে ?”
কাকিমা – “ওই তোর কাকার কাছে পিয়নের কাজ করত | বাগানের এক কোনে থাকত | বউ কবেই মারা গেছে | মেয়েটা বাগানময় চষে বেড়াত আর ফল, মূল যা পেত তুলে খেত ... তুই হাসির সাথে কথা বলিস নি তো ?”
আমি মাথা নাড়লাম – “কী হবে, কথা বললে ?”
কাকিমা হেসে কাছে টেনে বলল – “কী দরকার ? হাসি তোর চেয়ে অনেক বড় | কবেই বিয়ের বয়েস হয়েছিল | ওর বাবা ওর বিয়েও দিয়েছিল | কিন্তু মেয়েটা খেতে না পেয়ে রইল না স্বামীর কাছে, পালিয়ে এলো | এখন রোজ শাড়ি পরে বেরয় , চেয়ে চিন্তে, এখানে ফল, ওখানে চাল ডাল ... কোনমতে দিন চলে যায় বাবা মেয়ের ... যাকগে, থাক সে সব কথা |”

এর এক দিন পরে ভয়ঙ্কর কাল বৈশাখীর ঝড় উঠল ভর দুপুরে, তার পর তুমুল শিলাবৃষ্টি | বিকেল সেই ঝড় বৃষ্টি থেমে অদ্ভুত একটা সোনালী আলো ফুটল | আমি ছুটে গেলাম জাম গাছটার কাছে | চারিদিকে অজস্র জাম পড়ে, আর বেশ কিছু শিল, তখনও গলে নি | হাসি নেই | ওকে ডেকে আনার কথা ভেবে আমি সাহস করে ঝোপঝাড়ের মধ্যে ওর আসা যাওয়ার পথ ধরে এগুলাম | একটু দূরে যেতেই দেখলাম পথটা দেয়ালের ভাঙ্গার ভিতর দিয়ে বাইরে চলে গেছে | ভাঙ্গাটায় পৌঁছে উঁকি মেরে দেখেই থমকে গেলাম | দেয়ালের লাগোয়া একটা মাটির বাড়ি, তার চাল উড়ে গেছে | একটা মাঝ বয়সী লোক দিশাহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মনে হয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া জিনিস কুড়াতে কুড়াতে | একপাশে হাসি দাঁড়িয়ে, গায়ে ফ্রক | বোধহয় আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে ও তাকাল আর সংকুচিত হয়ে এক হাতে বুক আর এক হাতে তলপেট আড়াল করল | আমি বললাম, “অনেক জাম পড়ে আছে, হাসি, শিল লেগে একদম ঠাণ্ডা | শিগগির চলো |” হাসি কথা না বলে মাথা নেড়ে ফিরিয়ে তাকাল | ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম পাশে একটা বাবলা গাছের উপর ওর শাড়িটা বোধহয় ঝড়ে উড়ে গিয়ে আটকে শতচ্ছিন্ন হয়ে হাওয়ায় আছড়িয়ে আক্ষেপ করছে | ইঙ্গিতটা শেষ করে হাসি আমার দিকে মুখ ফিরালে, বিকেলের পড়ন্ত রোদে চকচক করে উঠল ওর সজল দুটো চোখ – যেন দুটো শিল ছোঁয়ানো কালো জাম |

বুঝলাম জাম কুড়ানোর পালা শেষ |

----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / 12 জুন ২০১৫

কোন মন্তব্য নেই: