|| মনে ধরে ||
সময়টা স্কুল থেকে ফেরার | উপেন বাবু রান্নাঘরের জানালা থেকে দেখলেন নিচে রাস্তায় একটা গাড়ি ঘিরে খুব ভিড় | গাড়ি থেকে একটু সরে দাঁড়িয়ে দু’জন মহিলা, সাথে স্কুল ফিরতি কয়েকটা বাচ্চা | কলোনির সিক্যুরিটির পোশাক পরা একটা লোক, আর একটা এমনি লোক গাড়িটার গা ঘেঁসে, তার দরজা আর বনেট খুলে কিছু করছে | এ ছাড়া বেশ কিছু নিষ্ক্রিয় লোক দাঁড়িয়ে দেখছে কী হচ্ছে |
উপেন বাবুর ফ্ল্যাট চার তলায় | তরকারী কেটে কুটে গ্যাসে বসিয়ে দিয়ে, ব্যালকনিতে এসে আঁচ করার চেষ্টা করলেন কী হয়েছে | পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন নেই | সেই সিক্যুরিটি গার্ড আর অন্য লোকটা হাতে কিছু সরঞ্জাম নিয়ে গাড়ির এদিক ওদিক খোঁচাখুঁচি করছে | মহিলা দু’জন, একজন বয়সী, পরনে ছিট কাপড়ের সালোয়ার কামিজ, অন্যজন, কম বয়সী, ছাই রঙের স্ল্যাক্সের উপর একটা সাদা টপ পরে, ঠায় দাঁড়িয়ে দেখছে | স্কুলের ব্যাগ পিঠে নিয়ে বাচ্চাগুলো একটু সরে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে | ঘন মেঘ করেছে | তারই কোথাও এক ফাঁক দিয়ে দুপরের তীব্র আলো চারিদিকে ঠিকরচ্ছে | এই ভ্যাপসা গরমে উপেন বাবু বেশি ক্ষণ দাঁড়াতে পারলেন না | ঘড়িতে দেখলেন সময় প্রায় দু’টো | রান্না ঘরে ফিরে রান্নায় মন দিলেন |
কিছুক্ষণ পরে আবার একবার রান্নাঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, একটা স্কুটারে করে দুজন লোক এসে নামল | পিছনে বসা লোকটা হাত থেকে একটা বাক্স মত নামিয়ে ঢাকনি খুলে লম্বা কিছু একটা বের করল | এত দূর থেকেও তার কমলা রঙের হাতল দেখে মনে হল স্ক্রু-ড্রাইভার | ‘ও, তাহলে এরা মেকানিক !’ ভাবলেন উপেন বাবু, ‘তার মানে গাড়িটা খারাপ হয়েছে | কিন্তু, অদ্ভুত তো, গাড়িটা স্কুল থেকে ফিরে, ঠিক বাড়িতে পৌঁছেই খারাপ হল !’
একটু পরেই ব্যাপারটা জানা গেল | একটা সিক্যুরিটি গার্ড এসে ঘণ্টি বাজিয়ে খাওয়ার জল চাইল | উপেন বাবু একটু বিরক্ত হলেন | এই এক জ্বালা হয়েছে | কেউ আসে কাউকে খুঁজতে, কেউ আসে খাওয়ার জল চাইতে | সবাই যেন এসে তাঁরই ঘণ্টি বজায় | অনেক বার ভেবেছেন জিজ্ঞাসা করবেন, “নিচের ফ্ল্যাটে কি কেউ নেই নাকি ? এই চার তলায় উঠে এসেছ |” কিন্তু, জিজ্ঞাসা করতে পারেন না | মৃদুলার কথা মনে করে চুপ করে যান | মৃদুলা আপত্তি করতেন, “আহা, এত গরমে কেউ একটু জলে চাইছে, দিয়েই দাও না |” তারপর স্বগতোক্তি করতেন, “মানুষটা যদি কাউকে কোনদিন মনে ধরে কিছু দিতে পারে | একদিনও দেখলাম না কাউকে খোলা মনে কিছু দিতে |” তবুও, প্রত্যেক বার উপেন বাবুর মনে প্রশ্নটা উসখুস করে, আর ভাবেন, ‘আচ্ছা, সবাই কি জেনে গেছে আমি একা থাকি ? না হলে গেরস্থ ঘরে না গিয়ে আমার কাছেই সবাই কিছু চাইতে আসে কেন ?’ আসলে, অযথা কারো সাথে কিছু দেয়া নেয়া উপেন বাবু পছন্দ করেন না | পাছে কোন নির্ভরতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে |
গার্ডটার জল খাওয়া হলে উপেন বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, ওই গাড়িটার কী হয়েছে ? তখন থেকে ভিড় দেখছি |” গার্ডটা নিঃস্পৃহ ভাবে বলল, “ওর দরজার লক খারাপ হয়ে গেছে |” উপেন বাবু বললেন, “বুঝলাম না | লক খারাপ মানে ?” গার্ড আবার সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল, “জাম হয়ে গেছে বাবু, লকটা জাম হয়ে গেছে |” গার্ডটাকে আর এক গেলাস জল এনে দিয়ে, এবং আরও বেশ কিছু প্রশ্ন করে জানা গেল ম্যাডাম (গার্ডের আঙ্গুল অনুযায়ী কম বয়সী মহিলা) নিজের এক বাচ্চা, আর পাড়ার আরও কিছু বাচ্চা নিয়ে স্কুল থেকে ফিরে গাড়ি থামিয়ে দেখে গাড়ির দরজার লক খুলছে না, এমন কী কাঁচও নামান যাচ্ছে না | গাড়ির ভিতরে আটকা পড়ে গিয়ে গরমে বাচ্চাদের দমবন্ধ হওয়ার জোগাড় | ম্যাডাম গাড়ি থেকে বেরনোর অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে মোবাইলে মাতাজীকে (গার্ড বয়সী মহিলাকে দেখাল) খবর দেয় | মাতাজী নিচে এসে সিক্যুরিটি গার্ডকে ডাকে | প্রথমে ম্যাডাম গাড়ির ভিতর থেকে বনেট খুলে দেয় | কিন্তু ব্যাটারি, ইলেকট্রিকাল তার, এইসব ঘাঁটাঘাঁটি করে কোন কাজ হয় না | তখন সিক্যুরিটি কাছের বস্তি থেকে একটা লোককে ডেকে আনে যে নাকি জানে কী ভাবে লক করা দরজা খোলা যায় | সে (গাড়ি চোর ?) গাড়ির জানালার আর কাঁচের মাঝের রাবারের পট্টি উপড়ে ফাঁক করে ভিতরে একটা লম্বা খুন্তি ঢুকিয়ে কোনও ভাবে দরজা খুলে ম্যাডাম আর বাচ্চাদের বের করে | গাড়িটা একদম নতুন | এখন ওই ম্যাডাম ভয় পাচ্ছে যে গাড়িতে বৃষ্টির জল ঢুকবে | তাই মিস্ত্রী ডাকা হয়েছে দেখাতে কী করা যায় | তবে সে ঠিক হবে কিনা বলতে পারছে না |
উপেন বাবু খেয়ে উঠেছেন কি বৃষ্টি নামল টিপটিপ করে | সেই সাথে ভয়ঙ্কর মেঘের ডাকে ইঙ্গিত যে জোরে বৃষ্টি নামবে একটু পরেই | উপেন বাবু ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলেন গাড়িটার আশেপাশে কেউ নেই | বনেট আর দরজা সব বন্ধ | কিন্তু, মনে হল যেন, গাড়িটার জানালার কাঁচ নামান | ‘সর্বনাশ’, ভাবলেন উপেন বাবু, ‘তা হলে তো গাড়ির ভিতরে জল ঢুকে যাবে |’ ঠিক তখনই তাঁর নজরে পড়ল, সামনের ফ্ল্যাটে তিন তলায় একটা জানালায় কেউ দাঁড়িয়ে গাড়িটা দেখছে |
খানিকক্ষণ পরে বৃষ্টিটা একটু থামলে উপেন বাবু কী কৌতূহলে আবার ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলেন সেই জানালায় সে আর নেই | তখনই নজরে পড়ল, ওই ফ্ল্যাটেরই ব্যালকনিতে সেই ছাই রঙের স্ল্যাক্স আর সাদা টপ পরা মহিলা দাঁড়িয়ে | একেবারে নিশ্চল | উপেন বাবু কল্পনা করলেন মহিলা মন খারাপ করছে এমন নতুন গাড়িটায় এই ভাবে জল ঢুকবে, নিশ্চয় সিটের গদি ভিজে যাবে, হয়ত নষ্টই হয়ে যাবে, বেশি ভিজলে |
উপেন বাবু শোয়ার ঘরে এসে আলমারি থেকে মেয়ের দেয়া দূরবীনটা বের করলেন | সচরাচর ব্যবহার করা হয় না | আর ফ্ল্যাটে বসে দেখবেনই বা কী | রান্নাঘরে এসে দূরবীনটা চোখে লাগিয়ে মহিলার মুখে তাক করলেন, দেখতে তাতে কি কোন দুঃখের ছাপ, নতুন গাড়ি নিয়ে | কিন্তু মেঘ করে আলো এত কমে এসেছে যে ঠিক বোঝা গেল না |
উপেন বাবু দূরবীনটা রেখে ঘরে তালা দিয়ে বেরলেন | নিচে এসে গ্যারেজের দরজা খুললেন | কলোনিতে খুব কম লোকের গ্যারেজ আছে | বেশির ভাগ লোক রাস্তায় গাড়ি রাখে | ওনার গ্যারেজ এখন খালি পড়ে থাকে | নিজের টাকায় কোন কালে গাড়ি কিনতে পারেন নি | মৃদুলা স্কুল থেকে অবসর নিলে তার পাওনা টাকায় শখ করে একটা গাড়ি কিনতে চেয়েছিলেন | পয়সার অপচয় হবে অজুহাতে উপেন বাবুর আপত্তি ছিল | মৃদুলা জোর করে গাড়ি কেনালে, উপেন বাবু একটা প্লাস্টিকের গাড়ি ঢাকার বর্ষাতি কিনেছিলেন | তারপর মৃদুলা কী ভাবে এই গ্যারেজটাও কিনে ফেলেন এক প্রতিবেশীর কাছে থেকে | উপেন বাবু গাড়ি চালান শিখতে চান নি, তাই মৃদুলা একটা ড্রাইভার রেখেছিলেন | মৃদুলা মারা গেলে মেয়ে গাড়িটা বিক্রি করে দেয় | কিন্তু গ্যারেজটা বিক্রি করে নি, বলেছে কোনদিন ফ্ল্যাটটা বিক্রি করলে গ্যারেজ শুদ্ধ বেশি দাম পাওয়া যাবে |
প্লাস্টিকের বর্ষাতিটা নিয়ে উপেন বাবু গার্ড রুমে গিয়ে দেখলেন সেই লোকটাই আছে যে জল খেতে এসেছিল | ওকে প্লাস্টিকটা দিয়ে বললেন, গিয়ে গাড়ির ম্যাডামকে দিয়ে আসতে | গার্ডটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বর্ষাতিটা নিয়ে চলে গেল |
তারপর উপেন বাবু ফ্ল্যাটে ফিরে এসে রান্না ঘরে গিয়ে জানালা দিয়ে তাকালেন | দেখলেন নিচে দুজন গার্ড বর্ষাতিটা গাড়িটার উপর বিছিয়ে দিয়ে কোনাগুলো আটকাচ্ছে | সেই মহিলা তার মাকে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে | উপেন বাবুর একবার মনে হল দূরবীনটা দিয়ে দেখেন মা মেয়ের মুখে সোয়াস্তির হাসি ফুটেছে কি, কিম্বা কোনও কৃতজ্ঞতার ছাপ ?
তার আগেই সহসা ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে চারিদিক ধোঁয়াটে হয়ে গেল | মা মেয়ে ব্যালকনি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল | যেতে যেতে যেন মৃদুলা একবার তাঁর দিকে চেয়ে দেখলেন, উপেন বাবুর মনে হল ||
----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৫ জুন ২০১৫
সময়টা স্কুল থেকে ফেরার | উপেন বাবু রান্নাঘরের জানালা থেকে দেখলেন নিচে রাস্তায় একটা গাড়ি ঘিরে খুব ভিড় | গাড়ি থেকে একটু সরে দাঁড়িয়ে দু’জন মহিলা, সাথে স্কুল ফিরতি কয়েকটা বাচ্চা | কলোনির সিক্যুরিটির পোশাক পরা একটা লোক, আর একটা এমনি লোক গাড়িটার গা ঘেঁসে, তার দরজা আর বনেট খুলে কিছু করছে | এ ছাড়া বেশ কিছু নিষ্ক্রিয় লোক দাঁড়িয়ে দেখছে কী হচ্ছে |
উপেন বাবুর ফ্ল্যাট চার তলায় | তরকারী কেটে কুটে গ্যাসে বসিয়ে দিয়ে, ব্যালকনিতে এসে আঁচ করার চেষ্টা করলেন কী হয়েছে | পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন নেই | সেই সিক্যুরিটি গার্ড আর অন্য লোকটা হাতে কিছু সরঞ্জাম নিয়ে গাড়ির এদিক ওদিক খোঁচাখুঁচি করছে | মহিলা দু’জন, একজন বয়সী, পরনে ছিট কাপড়ের সালোয়ার কামিজ, অন্যজন, কম বয়সী, ছাই রঙের স্ল্যাক্সের উপর একটা সাদা টপ পরে, ঠায় দাঁড়িয়ে দেখছে | স্কুলের ব্যাগ পিঠে নিয়ে বাচ্চাগুলো একটু সরে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে | ঘন মেঘ করেছে | তারই কোথাও এক ফাঁক দিয়ে দুপরের তীব্র আলো চারিদিকে ঠিকরচ্ছে | এই ভ্যাপসা গরমে উপেন বাবু বেশি ক্ষণ দাঁড়াতে পারলেন না | ঘড়িতে দেখলেন সময় প্রায় দু’টো | রান্না ঘরে ফিরে রান্নায় মন দিলেন |
কিছুক্ষণ পরে আবার একবার রান্নাঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, একটা স্কুটারে করে দুজন লোক এসে নামল | পিছনে বসা লোকটা হাত থেকে একটা বাক্স মত নামিয়ে ঢাকনি খুলে লম্বা কিছু একটা বের করল | এত দূর থেকেও তার কমলা রঙের হাতল দেখে মনে হল স্ক্রু-ড্রাইভার | ‘ও, তাহলে এরা মেকানিক !’ ভাবলেন উপেন বাবু, ‘তার মানে গাড়িটা খারাপ হয়েছে | কিন্তু, অদ্ভুত তো, গাড়িটা স্কুল থেকে ফিরে, ঠিক বাড়িতে পৌঁছেই খারাপ হল !’
একটু পরেই ব্যাপারটা জানা গেল | একটা সিক্যুরিটি গার্ড এসে ঘণ্টি বাজিয়ে খাওয়ার জল চাইল | উপেন বাবু একটু বিরক্ত হলেন | এই এক জ্বালা হয়েছে | কেউ আসে কাউকে খুঁজতে, কেউ আসে খাওয়ার জল চাইতে | সবাই যেন এসে তাঁরই ঘণ্টি বজায় | অনেক বার ভেবেছেন জিজ্ঞাসা করবেন, “নিচের ফ্ল্যাটে কি কেউ নেই নাকি ? এই চার তলায় উঠে এসেছ |” কিন্তু, জিজ্ঞাসা করতে পারেন না | মৃদুলার কথা মনে করে চুপ করে যান | মৃদুলা আপত্তি করতেন, “আহা, এত গরমে কেউ একটু জলে চাইছে, দিয়েই দাও না |” তারপর স্বগতোক্তি করতেন, “মানুষটা যদি কাউকে কোনদিন মনে ধরে কিছু দিতে পারে | একদিনও দেখলাম না কাউকে খোলা মনে কিছু দিতে |” তবুও, প্রত্যেক বার উপেন বাবুর মনে প্রশ্নটা উসখুস করে, আর ভাবেন, ‘আচ্ছা, সবাই কি জেনে গেছে আমি একা থাকি ? না হলে গেরস্থ ঘরে না গিয়ে আমার কাছেই সবাই কিছু চাইতে আসে কেন ?’ আসলে, অযথা কারো সাথে কিছু দেয়া নেয়া উপেন বাবু পছন্দ করেন না | পাছে কোন নির্ভরতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে |
গার্ডটার জল খাওয়া হলে উপেন বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, ওই গাড়িটার কী হয়েছে ? তখন থেকে ভিড় দেখছি |” গার্ডটা নিঃস্পৃহ ভাবে বলল, “ওর দরজার লক খারাপ হয়ে গেছে |” উপেন বাবু বললেন, “বুঝলাম না | লক খারাপ মানে ?” গার্ড আবার সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল, “জাম হয়ে গেছে বাবু, লকটা জাম হয়ে গেছে |” গার্ডটাকে আর এক গেলাস জল এনে দিয়ে, এবং আরও বেশ কিছু প্রশ্ন করে জানা গেল ম্যাডাম (গার্ডের আঙ্গুল অনুযায়ী কম বয়সী মহিলা) নিজের এক বাচ্চা, আর পাড়ার আরও কিছু বাচ্চা নিয়ে স্কুল থেকে ফিরে গাড়ি থামিয়ে দেখে গাড়ির দরজার লক খুলছে না, এমন কী কাঁচও নামান যাচ্ছে না | গাড়ির ভিতরে আটকা পড়ে গিয়ে গরমে বাচ্চাদের দমবন্ধ হওয়ার জোগাড় | ম্যাডাম গাড়ি থেকে বেরনোর অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে মোবাইলে মাতাজীকে (গার্ড বয়সী মহিলাকে দেখাল) খবর দেয় | মাতাজী নিচে এসে সিক্যুরিটি গার্ডকে ডাকে | প্রথমে ম্যাডাম গাড়ির ভিতর থেকে বনেট খুলে দেয় | কিন্তু ব্যাটারি, ইলেকট্রিকাল তার, এইসব ঘাঁটাঘাঁটি করে কোন কাজ হয় না | তখন সিক্যুরিটি কাছের বস্তি থেকে একটা লোককে ডেকে আনে যে নাকি জানে কী ভাবে লক করা দরজা খোলা যায় | সে (গাড়ি চোর ?) গাড়ির জানালার আর কাঁচের মাঝের রাবারের পট্টি উপড়ে ফাঁক করে ভিতরে একটা লম্বা খুন্তি ঢুকিয়ে কোনও ভাবে দরজা খুলে ম্যাডাম আর বাচ্চাদের বের করে | গাড়িটা একদম নতুন | এখন ওই ম্যাডাম ভয় পাচ্ছে যে গাড়িতে বৃষ্টির জল ঢুকবে | তাই মিস্ত্রী ডাকা হয়েছে দেখাতে কী করা যায় | তবে সে ঠিক হবে কিনা বলতে পারছে না |
উপেন বাবু খেয়ে উঠেছেন কি বৃষ্টি নামল টিপটিপ করে | সেই সাথে ভয়ঙ্কর মেঘের ডাকে ইঙ্গিত যে জোরে বৃষ্টি নামবে একটু পরেই | উপেন বাবু ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলেন গাড়িটার আশেপাশে কেউ নেই | বনেট আর দরজা সব বন্ধ | কিন্তু, মনে হল যেন, গাড়িটার জানালার কাঁচ নামান | ‘সর্বনাশ’, ভাবলেন উপেন বাবু, ‘তা হলে তো গাড়ির ভিতরে জল ঢুকে যাবে |’ ঠিক তখনই তাঁর নজরে পড়ল, সামনের ফ্ল্যাটে তিন তলায় একটা জানালায় কেউ দাঁড়িয়ে গাড়িটা দেখছে |
খানিকক্ষণ পরে বৃষ্টিটা একটু থামলে উপেন বাবু কী কৌতূহলে আবার ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলেন সেই জানালায় সে আর নেই | তখনই নজরে পড়ল, ওই ফ্ল্যাটেরই ব্যালকনিতে সেই ছাই রঙের স্ল্যাক্স আর সাদা টপ পরা মহিলা দাঁড়িয়ে | একেবারে নিশ্চল | উপেন বাবু কল্পনা করলেন মহিলা মন খারাপ করছে এমন নতুন গাড়িটায় এই ভাবে জল ঢুকবে, নিশ্চয় সিটের গদি ভিজে যাবে, হয়ত নষ্টই হয়ে যাবে, বেশি ভিজলে |
উপেন বাবু শোয়ার ঘরে এসে আলমারি থেকে মেয়ের দেয়া দূরবীনটা বের করলেন | সচরাচর ব্যবহার করা হয় না | আর ফ্ল্যাটে বসে দেখবেনই বা কী | রান্নাঘরে এসে দূরবীনটা চোখে লাগিয়ে মহিলার মুখে তাক করলেন, দেখতে তাতে কি কোন দুঃখের ছাপ, নতুন গাড়ি নিয়ে | কিন্তু মেঘ করে আলো এত কমে এসেছে যে ঠিক বোঝা গেল না |
উপেন বাবু দূরবীনটা রেখে ঘরে তালা দিয়ে বেরলেন | নিচে এসে গ্যারেজের দরজা খুললেন | কলোনিতে খুব কম লোকের গ্যারেজ আছে | বেশির ভাগ লোক রাস্তায় গাড়ি রাখে | ওনার গ্যারেজ এখন খালি পড়ে থাকে | নিজের টাকায় কোন কালে গাড়ি কিনতে পারেন নি | মৃদুলা স্কুল থেকে অবসর নিলে তার পাওনা টাকায় শখ করে একটা গাড়ি কিনতে চেয়েছিলেন | পয়সার অপচয় হবে অজুহাতে উপেন বাবুর আপত্তি ছিল | মৃদুলা জোর করে গাড়ি কেনালে, উপেন বাবু একটা প্লাস্টিকের গাড়ি ঢাকার বর্ষাতি কিনেছিলেন | তারপর মৃদুলা কী ভাবে এই গ্যারেজটাও কিনে ফেলেন এক প্রতিবেশীর কাছে থেকে | উপেন বাবু গাড়ি চালান শিখতে চান নি, তাই মৃদুলা একটা ড্রাইভার রেখেছিলেন | মৃদুলা মারা গেলে মেয়ে গাড়িটা বিক্রি করে দেয় | কিন্তু গ্যারেজটা বিক্রি করে নি, বলেছে কোনদিন ফ্ল্যাটটা বিক্রি করলে গ্যারেজ শুদ্ধ বেশি দাম পাওয়া যাবে |
প্লাস্টিকের বর্ষাতিটা নিয়ে উপেন বাবু গার্ড রুমে গিয়ে দেখলেন সেই লোকটাই আছে যে জল খেতে এসেছিল | ওকে প্লাস্টিকটা দিয়ে বললেন, গিয়ে গাড়ির ম্যাডামকে দিয়ে আসতে | গার্ডটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বর্ষাতিটা নিয়ে চলে গেল |
তারপর উপেন বাবু ফ্ল্যাটে ফিরে এসে রান্না ঘরে গিয়ে জানালা দিয়ে তাকালেন | দেখলেন নিচে দুজন গার্ড বর্ষাতিটা গাড়িটার উপর বিছিয়ে দিয়ে কোনাগুলো আটকাচ্ছে | সেই মহিলা তার মাকে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে | উপেন বাবুর একবার মনে হল দূরবীনটা দিয়ে দেখেন মা মেয়ের মুখে সোয়াস্তির হাসি ফুটেছে কি, কিম্বা কোনও কৃতজ্ঞতার ছাপ ?
তার আগেই সহসা ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে চারিদিক ধোঁয়াটে হয়ে গেল | মা মেয়ে ব্যালকনি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল | যেতে যেতে যেন মৃদুলা একবার তাঁর দিকে চেয়ে দেখলেন, উপেন বাবুর মনে হল ||
----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৫ জুন ২০১৫
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন